নয়াকৃষিঃ আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়নসংস্থা ইফাদ এর অর্থায়নে ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর এর কারিগরি সহযোগিতায় ২০১৭ সালের মে মাস হতে PACE প্রকল্পের আওতায় ‘নিরাপদ পদ্ধতিতে সাধারণ ও উচ্চমূল্যের সবজি চাষের মাধ্যমে কৃষকের আয়বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক উপ-প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে এসডিএস। এই প্রকল্পের আওতায় শরীয়তপুর জেলার জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও নড়িয়া উপজেলার ৬ হাজার সবজি চাষীদের নিয়ে কাজ করা হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চ মূল্যের এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক মুক্ত শাক-সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরাপদ সবজি চাষ উপ-প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করে এসডিএস। উল্লেখ্য যে, চলমান অর্থবছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হতে যাচ্ছে।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া,ভেদরগঞ্জ এবং জাজিরা উজেলায় ৬০০০ জন উদ্যোক্তা নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের মাঝে নিরাপদ পদ্ধতিতে সাধারণ ও উচ্চমূল্যের সবজি উৎপাদনের চাষ পদ্ধতি, জৈব সার এর ব্যবহার বৃদ্ধি, ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত বালাইনাশক (ট্রাইকোগামা পোকা, বায়োপেষ্টিসাইড, ফেরোমেন ফাঁদ ইত্যাদি) এর ব্যবহার, সবজি সংগ্রহ, গ্রেডিং এবং বাজারজাতকরণ প্রভূতি বিষয়ে উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের সহায়তায় ক্ষতিকর কীটনাশক মুক্ত সবজির প্রচার ও প্রসারে লিফলেট ও পোস্টার বিতরন, সবজির বিষমুক্ততা পরীক্ষা, কীটনাশকমুক্ত সবজি এর উপর অডিও-ভিডিও ডকুমেন্টস প্রদর্শণী, দৈনিক পত্রিকায় খবর ছাপানো, বিষমুক্ত সবজি মেলার আয়োজন, বাজারজাতকরনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে কর্মশালার আয়োজন ইত্যাদি কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, সবজি নষ্ট হওয়ার হার ২০-২৫% হতে ০-৫% এ নেমে এসেছে। সবজি উৎপাদন ব্যয় কমেছে প্রায় ২০-৩০%, কীটনাশক ব্যবহারের কমেছে প্রায় ৪৫%। উল্লেখ্য, পিকেএসএফ-এর নিরাপদ সবজি চাষের আওতায় শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার ৩টি উপজেলায় সবজি চাষের ক্ষেত্রে কম্পোস্ট, ট্রাইকো-কম্পোস্ট, ফেরোমোন ফাঁদ এর ব্যবহার, উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের সবজি চাষ, বসতবাড়িতে সারা বছর সবজি চাষের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, সবজি চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার, ভার্মি কম্পোস্ট তৈরী প্রভুতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। যা মাঠ পর্যায়ে চাষীদের আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
প্রকল্প এলাকায় পূর্বে একজন চাষী এক মৌসুমে শাক-সবজি চাষের জন্য বিঘা প্রতি মোট গড়ে ৩০,০০০/- টাকা বিনিয়োগ করতো। সাভাবিক উৎপাদন হলে উক্ত জমি হতে একজন চাষি গড়ে ২.৮ মে.টন শাক-সবজি উৎপাদন হতো যা হতে প্রায় ৫৬,০০০/- টাকা আয় করে থাকে: নীট মুনাফা প্রায় ২৬,০০০/- টাকা। প্রকল্পের আওতায় চাষীদের সঠিক পদ্ধতিতে শাক-সবজি চাষ, মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জমিতে ভাল ও পরিমানমত বীজ প্রয়োগ, পরিমানমত সার ও জৈব বালাই নাশক প্রয়োগ, সঠিকভাবে ফসল সংগ্রহ, রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কমিয়ে নিজ বাড়িতে উৎপাদিত ভার্মি কম্পোষ্ট সার প্রয়োগ, ফসলের গ্রেডিং ও প্যাকেজিং ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান, কৃষকদের অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর, নিরাপদ সবজিকে ব্র্যান্ড হিসাবে বিবেচনা করে বাজার সম্প্রসারনে নানাবিধ কর্মকান্ড যেমন মার্কেট এক্টরদের সাথে কর্মশালা, নিরাপদ সবজির উপর ভিডিও চিত্র ধারন, নির্বাচিত সীমিত সংখ্যক বিক্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ সবজি বিক্রয়ের ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারনা চালানো, সবজি মেলায় অংশগ্রহন প্রভূতির আয়োজনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহন করা হয়। এতে বিঘা প্রতি ক্ষতিকর কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজির উৎপাদন ১০% বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় প্রায় ৩.১ মে.টন।
প্রকল্পভূক্ত প্রতি বছর যেখানে ৯০,০৫০ মেট্রিক টন বিষযুক্ত শাক-সবজি (বর্তমান গড় বাজার মূল্য প্রায় ১৪৭.০৪ কোটি টাকা) উৎপাদন করে থাকে সেখানে প্রকল্প পরবর্তীতে নিরাপদ শাক-সবজির উৎপাদন বেড়ে দাড়িয়েছে ১,১৮,২৩৬.০ মে.টন (বাজার মূল্য হবে ১৯১.০ কোটি টাকা)। জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কমিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার, পরিমানমত বীজ বপন এবং অতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে পরিমানমত জৈব বালাইনাশকের ব্যবহারের ফলে বিঘা প্রতি সবজি উৎপাদনের ব্যয় পূর্ব হতে প্রায় ২০-২৫% হ্রাস পেয়েছে; এখন উৎপাদন ব্যয় প্রায় ২৪,০০০/- টাকা। ভ্যালু চেইন প্রকল্পটি গ্রহনের ফলে গড় মুনাফা বৃদ্ধি ২০% পেয়েছে।
শিক্ষনীয়ঃ বাংলাদেশে ৭০’দশকে মানুষ রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ছাড়া ফসল উৎপাদন করলেও বিভিন্ন কোম্পানি/কারখানার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে অধিক মুনাফার আশায় রাসায়নিক সার এবং বিষ ব্যবহার শেখা শুরু করে।ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করে যে, অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার এবং বিষ ব্যবহার করা হলে অধিক ফসল পাওয়া যাবে। ফলে অধিক লাভের আশায় মানুষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে জমিতে রাসায়নিক সার এবং বিষের ব্যবহার করতে থাকে। যা আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি বা খাদ্য চাহিদা মেটালেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারেনি।আর এর ফলশ্রুতিতে জমির উর্বরতা,জীব বৈচিত্র ও ফসলের পুষ্টিমাণ কমে যেতে শুরু করে এবং তা গ্রহনের ফলে মানবদেহে ক্যান্সার, মাইগ্রেনসহ নানাবিধ রোগের আধিক্যতা দেখা যাচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা যা শিখেছি। যেমন-
- পরিমিত সার এবং জৈবসার বালাইনাশক এর সমন্বয়ে চাষাবাদ করা গেলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের সাথে কাঙ্খিত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব
- সঠিক প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশন করা গেলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানো সম্ভব
- রাসায়নিক সারের বিকল্প হতে পারে জৈবসার (ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাইকো-কম্পোস্ট,সবুজ সার ইত্যাদি)
- কীটনাশকের বিকল্প হতে পারে জৈব বালাইনাশক (সেক্স ফেরোমন ফাদ, হলুদ ফাদ, ফাদ ফসল, শ্যাম্পু/হলুদ বা মরিচের গুড়া/ নিম বা মেহগনি ফলের রস/ট্রাইকো-ডার্মা/আদা ইত্যাদি)
- নিরাপদ উপকরণ সহজলভ্য এবং ফসলের বাজারজাত করা গেলে এই প্রযুক্তি টেকসই করা সম্ভব