পাট বাংলাদেশের একটি আঁশ জাতীয় মাঠ ফসল। বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতি, জীবন ও সংস্কৃতির সাথে পাটের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। বাংলাদেশকে সোনালী আঁশের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছে পাট। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দেড় যুগ পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল প্রধান রপ্তানি পণ্য। একদিকে সোনালি আঁশ অন্যদিকে রূপালি কাঠি দুইয়ে মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে পাট।
পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টন; যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ। প্রায় ২০ লাখ টন উৎপাদন করে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। ভারতে হয় বিশ্বের ৫৫ শতাংশ উৎপাদন। তবে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশ। পাট দিয়ে ২৮৫ ধরনের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করা হয় (প্রথম আলো, ২৭ জুলাই,২০২৩)। মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
গবেষণায় দেখা গেছে পাট গাছ মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলি ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। দ্বিতীয়ত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাট উৎপাদন কালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে পড়ে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়া পাট কাটার পর জমিতে পাটগাছের গোড়াসহ যে শেকড় থেকে যায় তা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার যোগ করে। এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে।
আমাদের দেশে প্রতিবছর গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাট পাতা ও ৪২৩.৪০ হাজার টন পাটগাছের শিকড় মাটির সঙ্গে মিশে যায়, যা জমির উর্বরতা ও মাটির গুনগতমান বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। এ কারণে যে জমিতে পাট চাষ হয়, সেখানে অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়। সারাবিশ্বে বছরে প্রায় ৪৭.৬৮ মিলিয়ন টন কাঁচা সবুজ পাটগাছ উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৫.৭২ মিলিয়ন টন কাঁচাপাতা। পাট ফসলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটারে ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। এ কারণে পাট গাছ পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে পৃথিবীকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। অন্যদিকে পাট ফসল ১০০ দিনে হেক্টর প্রতি ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে ও ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। বনের গাছ কেটে মন্ড তৈরি করে কাগজ তৈরি হয়। এক টন কাগজ তৈরি করতে ১৭টি পরিণত গাছ কাটতে হয়। পরিবেশ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে পাটকাঠি দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে পেপার পাল্প তৈরি করা যায়। পাটকাঠি জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ও পেপার পাল্প তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়ায় বন উজারের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিবেশ রক্ষা পেতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, শুধু ঢাকাতেই মাসে ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার ১০ লাখেরও বেশি পাখি এবং জলজপ্রাণী। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এ বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪% ব্যবহৃত হয়।
প্লাস্টিকব্যাগ জৈব বিয়োজনশীল নয় অর্থাৎ এটি মাটিতে সহযে পচেনা। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড মেশে। এসব ক্ষতির কথা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য মোড়কীকরণে পাটের থলে ও বস্তা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। বর্তমান বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে।
পরিবেশ বান্ধব সরকার ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ ও ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা-২০১৩’ এর মাধ্যমে (ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, আদা, পেয়াজ, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু,আটা, ময়দা ও তুষ-খুদ-কুড়া) সতেরটি পণ্য যে কোনো পরিমাণ সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। পৃথিবী বাঁচাতে পরিবেশবাদীরা আজ বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম তন্তু বর্জনের ডাক দিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে, জাতিসংঘ ২০০৯ সালকে ‘‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’’হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর পরপরই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ সচেতনতার জন্য এই চাহিদা আরও বাড়বে। তাই পাটের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।
বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন পলিথিন ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া থেকে পরিবেশ বাঁচাতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে পাটের কাছে। পাট থেকে তৈরি জুট জিও-টেক্সটাইল বাঁধ নির্মাণ, ভূমিক্ষয় রোধ, পাহাড় ধস রোধে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশের উন্নত পাট এখন বিশ্বের অনেক দেশে গাড়ি নির্মাণ, কম্পিউটার বডি, উড়োজাহাজের পার্টস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পেও বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত পাট।
পাটকাঠি থেকে তৈরি চারকোল খুবই উচ্চমূল্যের, যা দিয়ে আতশবাজি, কার্বনপেপার, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট, ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারিসহ নানা ধরনের জিনিস তৈরি করা হয়। ইতোমধ্যে বিজেআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা পাট দিয়ে টিন তৈরি করেছেন। যার নাম দিয়েছেন ‘জুটিন’। তারা বলছেন জুটিন হবে পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও সাশ্রয়ী। এছাড়াও পাট দিয়ে টাইলস, নৌকা, চেয়ার-টেবিল তৈরির আয়োজন চলছে; যেগুলো ধাতব স্টিলের চেয়েও বেশি মজবুত। পাটের সুতা দিয়ে তৈরি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শোপিস, ওয়ালমেট, নকশিকাঁথা, পাপোস, জুতা, শিকাসহ নানান পাটজাত পণ্য যেমন আকর্ষণীয় তেমনই পরিবেশবান্ধব। পাটের কচিপাতা আমাদের দেশে বেশ উপাদেয় শাক হিসেবে পরিচিত। শুকনো পাটপাতা দিয়ে অর্গানিক চা উৎপাদনও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মেস্তা পাটের বৃতি থেকে আরেক ধরনের চা উৎপাদন শুরু হয়েছে যেটি রোজেলি টি হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং যা ইতোমধ্যেই মানুষের নজর কাড়তে শুরু করেছে। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্ব বাজারে এখনো কাঁচাপাটের অন্যতম যোগানদাতা বাংলাদেশ।
বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২.৫-৩.০ কোটি মানুষ পাট শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ১২ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে পাট উৎপাদনের কাজে। তাই পাটের ভবিষ্যতের সাথে জড়িয়ে আছে জাতীয় স্বার্থ। পরিবেশ রক্ষায় পাটের রয়েছে বিরাট অবদান। পাটই হতে পারে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
লেখকঃ মোঃ শামীম-আল-মামুন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট